বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৫৫ অপরাহ্ন

ইন্ধন খুঁজছে পুলিশ

ইন্ধন খুঁজছে পুলিশ

স্বদেশ ডেস্ক:

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে চলমান আন্দোলনে অসৎ উদ্দেশ্যে অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অর্থ-সহায়তা দেওয়া ৩৫৭ জনকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযোগের ব্যাপারে জানতে রাজধানী থেকে সোমবার শাবিপ্রবির সাবেক পাঁচ ছাত্রকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহায়তায় গ্রেপ্তার করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)। পুলিশের দাবি, গ্রেপ্তারকৃতরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের খাবার ও চিকিৎসার জন্য ২৫ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়েছেন।

এদিকে, অর্থ সহায়তা দেওয়ার জন্য শাবিপ্রবির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে খোলা ফেসবুক গ্রুপ ‘ফোরাম ফর সাস্টিয়ান ফুড অ্যান্ড ফেয়ার’ ডিলেট করে দেওয়া হয়েছে। অর্থ সহায়তা নেওয়া মোবাইল নম্বরগুলোও সোমবার থেকে বন্ধ।

তবে অর্থ সহায়তা প্রদান করা একাধিক সাবেক শিক্ষার্থী আমাদের সময়কে বলছেন, চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও খাবারের জন্য তারা অল্প কিছু অর্থ দিয়েছেন। ক্যাম্পাসে তারা তারুণ্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় কাটিয়েছেন। বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাদের ছোট ভাই। আপনজন। বিভিন্ন সময় তাদের আবদার সাবেক শিক্ষার্থীরা পূরণ করে থাকে। তাদের খাবারের জন্য ২/৪শ করে টাকা দেওয়ার মধ্যে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। ছোট ভাইদের কয়েকশ টাকা দেওয়ার জন্য মেধাবী সন্তানদের ধরে নিয়ে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত বলে উল্লেখ করেন তারা। ধরপাকড় বাদ দিয়ে তারা চান ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসুক।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার রাত পর্যন্ত শাবিপ্রবির সাবেক পাঁচ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- একেএম মারুফ হোসেন, রেজানুর মুইন, এফএম নাজমুল সাকিব, ফয়সাল আহমেদ ও হাবিবুর রহমান। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ২৫ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে মারুফ দিয়েছেন ১০ হাজার ২৫০ টাকা, ফয়সাল ৫১০০ টাকা, মুইন ২৫০০ টাকা, হাবিবুর ৫০০০ টাকা ও সাকিব ৩ হাজার টাকা দেন।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্থদাতাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালিয়েছে। সিআইডি তাদের সহায়তা করেছে। গ্রেপ্তারের পর সিলেট পুলিশের কাছে পাঁচজনকে হস্তান্তর করেছে সিআইডি।

কর্মকর্তারা বলছেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অর্থ সংগ্রহের জন্য শাবিপ্রবির সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের নিয়ে ফেসবুক গ্রুপ ‘ফোরাম ফর সাস্টিয়ান ফুড অ্যান্ড ফেয়ার’ তৈরি করেন। দেশ ও দেশের বাইরে থাকা ছাত্ররা এ গ্রুপে অংশ নেন। গ্রুপে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজনের মোবাইল ফোন নম্বর ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চিকিৎসা ও খাবারের জন্য অর্থ সহায়তা দিতে বলা হয়। সোমবার পর্যন্ত এসব মোবাইল নম্বর ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিছু অর্থ জমা হয়। শিক্ষার্থীদের অর্থ সহায়তা দেওয়া ৩৫৭টি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে বিকাশের মাধ্যমে ২৩৭ জন, রকেটে ২৩ জন, নগদে ১৭ জন, ব্যাংকের মাধ্যমে ৪১ জন ও বিদেশ থেকে ৩৯ জন টাকা পাঠিয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, সাবেক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা পেয়ে আন্দোলনকারীরা বিশৃঙ্খলার সুযোগ পাচ্ছে। পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। শুধু সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে সরল মনে তারা টাকা দিচ্ছে নাকি রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য আছে, তা খতিয়ে দেখার জন্যই কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আন্দোলনকারী আরিফুল ইসলাম বলেছেন, আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সব মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর সোমবার দুপুরের পর থেকে কাজ করছে না। ওই মুঠোফোন নম্বরগুলো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।

সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ আমাদের সময়কে বলেন, ‘ঢাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর শাবিপ্রবির পাঁচ ছাত্রকে ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে আসা হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অসৎ উদ্দেশে অর্থ দেওয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তারা টাকা দিয়ে উসকানি দিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীরা যে শুধু খাবার কিনবে আর চিকিৎসা নেবে, সেটা নাও হতে পারে।’

গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনের মধ্যে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হাবিবুর রহমান (স্বপন)। তিনি বর্তমানে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অপরজন হলেন স্থাপত্য বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র রেজা নূর মুঈন। রেজা দেশের একটি খ্যাতনামা শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্থপতি হিসেবে কাজ করছেন।

শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষার্থী শাহ রাজী সিদ্দিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমি আর হাবিবুর প্রায় আড়াই বছর ধরে একসঙ্গে থাকি। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি ও তার পরিবার ঢাকায় হাবিবের স্থানীয় অভিভাবক। সোমবার বেলা তিনটার দিকে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টর এলাকা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তিনজন হাবিবকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। অথচ সাবেক ছাত্র হিসেবে মাত্র এক হাজার টাকা আন্দোলনকারীদের দিয়েছিল। তিনি বলেন, সোমবার হাবিবুরের জার্মানিতে যাওয়ার ভিসা হয়েছে। সেখানকার একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে সে। অন্যদিকে রেজার সন্তান খুবই ছোট। রেজা তার স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে রাজউক-উত্তরা আবাসিক এলাকায় থাকেন। গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ সদস্যরা জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিকাশে কিছু টাকা পাঠিয়েছিলেন এ দুজন। সে জন্যই তাদের নিয়ে যাওয়া হয়।

ক্যাম্পাসে অনশনকারীদের স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ

এদিকে আমাদের সময়ের সিলেট ও শাবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, অনশনরত শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবায় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাঠানো স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা ক্যাম্পাস থেকে ফিরে গেছেন। সোমবার রাত ২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আর কোনো স্বাস্থ্যসেবা আমরা পাচ্ছি না। এর ফলে অনশনরত শিক্ষার্থীরা আরও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে গেলেন।

অনশনরত ২৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ জন সিলেটের তিনটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকি ৯ জন আছেন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা পাঠানোর কয়েকটি মোবাইল অ্যাকাউন্ট কাজ করছে না। সোমবার সকাল থেকে ক্যাম্পাসের খাবার দোকানও বন্ধ রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, হ্যান্ডবল গ্রাউন্ডের পাশের তিনটি ফুডকোর্ট এবং পরিবহন গ্যারেজের পাশের টং দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে।

আন্দোলন শুরুর পর থেকে নিজের বাসভবনে অবরুদ্ধ রয়েছেন উপাচার্য। গতকাল তার জন্য খাবার নিয়ে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সেই খাবার উপাচার্যের কাছে পৌঁছে দেন নিরাপত্তা কর্মীরা।

২ দিন পর উপাচার্যের বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় চালু করে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এর আগে গত শনিবার গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আন্দোলনকারীরা জানান, উপাচার্যের বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগে আশপাশের কয়েকটি বাড়ি চলে। এসব বাড়িতে অনেকেই অসুস্থ। তাই বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় চালু করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন সিলেট-২ আসনের (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) সংসদ সদস্য ও গণফোরামের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান।

দ্রুত সমাধান চায় রাবি শিক্ষক সমিতি

রাবি প্রতিনিধি জানান, শাবিপ্রবির আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষক সমিতি। গতকাল সমিতির এক বিবৃতিতে বলা হয়, শাবিপ্রবির ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত। অনশনরত অনেকেই অসুস্থ। তাদের দাবির প্রতি আমরা সহমর্মী। সমিতির নেতারা বলেন, ‘বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

শাবিপ্রবি ইস্যুতে একই দিন ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। এতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শাবিতে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বিনা উসকানিতে যে হামলা চালিয়েছে, সেটা ক্ষমা চাওয়ার অপরাধ নয়, এটা ফৌজদারি অপরাধ। এর পর উপাচার্যের পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। তিনি যদি আজকের মধ্যেই পদত্যাগ করেন, তা হলে সেটাই হবে মঙ্গল।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877